সৌন্দর্যের পাতিহাস কেনো কুৎসিত?
... ... ...
"Beauty is in the eye of the beholder."
- লাইনটা খ্রিস্টের জন্মের ৩সেঞ্চুরির আগের।
তবে সেসময় অবশ্য লাইনটা যদিও এমন ছিলোনা হুবহু।
নাইন্টিন সেঞ্চুরির দিকে এসে লাইনটা ওরকমই প্রচলিত হয়ে যায়। সোজা বাংলায় যার মানে দাড় করানো যায়ঃ
..."সাব্জেক্টিভ বিউটি দর্শকের দেখার উপর নির্ভর করে"...
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি আদৌ তাই?
ইতিহাস বলে এনশিয়েন্ট গ্রিকে, সৌন্দর্যকে মাপা হতো সময় দিয়ে।
একটা পাকা আম, সুন্দর। কারণ একটা পাকা আম চাইলেও বিপরীতে এসে কাঁচা আম সাজতে পারবেনা। তাই একটা পাকা আম সুন্দর।
একজন তরুণীর বৃদ্ধা সাজাকে, বা বৃদ্ধার তরুণী সাজাকে বা সেই রেজাল্টকে সৌন্দর্যের আওতায় আনা হতোনা সেসময়।
এনশিয়েন্ট গ্রীকে 'পরিপূর্ণতাকে' সৌন্দর্য ভাবা হতো।
সময় নিয়ে নিয়ে যে পুষ্ট হয়েছে, অভিজ্ঞ হয়েছে, পেঁকেছে, সেই সুন্দর।
এরপর আস্তেধীরে বদলাতে লাগলো সংজ্ঞা...
পীথাগোরাসের যুগে যখন গণিতের রমরমা চারিদিকে।
তখন সৌন্দর্যের মাপকাঠি দাড়ালো, সুবিন্যস্ততা।
..."যাহাই সুনিপুণ ভাবে বিন্যস্ত, তাহাই সুন্দর।"...
যেকারণে তখনকার সবকিছুকে নির্দিষ্ট কোনো ছন্দে সাজানোর প্রতি সবার একটা ঝোঁক কাজ করতো। গণিতের মধ্যে তারা সৌন্দর্যকে খুঁজে পেতে চাইলো।
তারা ভাবতে লাগলো, যে বস্তু 'Golden Ratio' মেনে সাজানো থাকে তাই বুঝি সুন্দর।
তবে ভাববাদী প্লেটোর কাছে সংজ্ঞাটা অন্যরকম ছিলো। তিনি বললেন,
..."সৌন্দর্য হচ্ছে এমন একটা চিন্তা যা সকল চিন্তার উপরের আইডিয়া।
সকল চিন্তাকে আকার দেয় যে আইডিয়া, সৌন্দর্য হচ্ছে সেরকম একটি চিন্তা।"...
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে প্লেটো সৌন্দর্যকে ঐশ্বরিক লেভেলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু বস্তুবাদী এরিস্টটল সেভাবে দেখেননি।
তিনি সৌন্দর্যকে ঐশ্বরিক কিছু ভাবতে নারাজ ছিলেন। তিনি দাবী করলেন,
..."সৌন্দর্য একটি গুণ।
এবং অন্য সকল গুণই চায় এই সৌন্দর্যের কাছাকাছি এসে মিশে যেতে।"...
মূলত বর্তমানে আমরা সৌন্দর্যের যে সাধারণ সংজ্ঞার প্রতিফলন দেখি, তা প্লেটোনিক চিন্তা নয় বরং এরিস্টটলের চিন্তারই একটি প্রকাশ।
যেকোনো বস্তুবাদীর কাছেই সৌন্দর্য একপ্রকার গুণ, যা এচিভ করা যায়। এটা ঐশ্বরিক কিছু নয়।
... ... ....
তবে গোথিক যুগে এসে আমাদের এতদিনকার খোলামেলা সৌন্দর্য ঢেকে গেলো ধর্মের আবরণে।
ক্যাথেলিকরা চারিদিকে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে সফল হলো সৌন্দর্য প্রকাশের জিনিস নয় বরং তা প্রকাশ করাটাই পাপ।
সুতরাং সৌন্দর্য জিনিসটাই সংজ্ঞায়িত হয়ে গেলো, 'একপ্রকার নিষিদ্ধ আকর্ষণ' হিসেবে।
পরে রেনেসাঁসের সময়ে এসে মনুষ্যবাদীর দলের চাপে গোথিক চিন্তাভাবনাটা বাতিলের খাতায় নাম লেখালো। তারা ক্রিটিসাইজ করলো ক্যাথলিকদের, এহেন নিম্নমানের চিন্তাভাবনার জন্য।
..."সৌন্দর্য ঢেকে রাখাটাই বরং পাপ হওয়া উচিত।
অবলোকনেই সৌন্দর্যের মাহাত্ম্য।"...
রেনেসাঁসের সময়ে এমন কিছু চিন্তাভাবনাই চারিদিকে ঘুরতে লাগলো।
... ... ...
মধ্যযুগে এসে সৌন্দর্যের ক্রাইটেরিয়া হিসেবে দাড়ালো ৩টি জিনিসঃ
- সম্পূর্নতা
- ছন্দময়তা
- উজ্জ্বলতা
উজ্জ্বল ধারণাটায় আপনার ভ্রু কোঁচকাতে পারে। তার আগেই ক্ল্যারিফাই করে নিই,
গোথিক যুগে 'আলোকে' ভাবা হতো ঈশ্বরপ্রদত্ত সবচেয়ে সুন্দর জিনিস।
..."যেকোনো জিনিসই যা আলোর মত উজ্জ্বল, তাই সুন্দর।"...
ভাবনাটার প্রতিফলন পাবেন, তৎকালীন ক্যাথলিকদের লাইনটাতেঃ
"Let there be light"
... ... ...
এরপর আসলো রোমান্টিক যুগ, যে যুগে সৌন্দর্য মোটেও আলোর মত উজ্জ্বল কোনো বস্তুতেই সীমাবদ্ধ রইলোনা। সৌন্দর্য রূপ নিলো আবারো ঈশ্বর প্রদত্ত একটি বিষয়ে।
জন কীটসের একটা লাইন ছিলো অনেকটা এমন,
..."সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর।
পৃথিবীতে এটাই তুমি জানবে,
আর এটা জানাটাই যথেষ্ট।"...
বাংলাটা সুন্দরভাবে অনুবাদ করতে পারিনি যদিও।
ইংলিশটা আরোও সুন্দর...
"Beauty is truth, truth beauty, — that is all
Ye know on earth, and all ye need to know."
সৌন্দর্যের গুণগান আবারও প্লেটোনিক চিন্তাতে রূপ নিতে শুরু করলো...
... ... ...
পোস্ট রোমান্টিক এরায় এসে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দিতে এসে, আবারও মোচড় খেলো সৌন্দর্যের সংজ্ঞা।
তারা সৌন্দর্যকে দর্শনের বিষয় হিসেবে ভাবতে নারাজ।
তারা সৌন্দর্যকে বদলে দিলো "পাওয়ার" দিয়ে।
..."নিজের হাতে পাওয়ার রাখতে পারাটাই সৌন্দর্য।"...
পরে ঘষেমেজে শব্দটাকে তারা বদলে দিলো, "জাস্টিসে".
..."সুবিচার মানেই সুন্দর"...
এবং এই চিন্তার হাত ধরেই সৌন্দর্যকে একটা মূল্যবান জিনিস হিসেবে দেখা শুরু হলো। এবং যখন থেকে মানুশ সৌন্দর্যকে একটি মূল্যবান জিনিস হিসেবে দেখা শুরু করলো তখন ঘটলো মহাবিপত্তি!
এতক্ষণ যাবত 'সৌন্দর্য' কথাটির মধ্যে সকলকিছু আসতো,
গাছ, আকাশ, ফল, হরিণ, মেয়ে মানুষ, ছেলে মানুষ সবকিছুই। কিন্তু যখনই সৌন্দর্যকে মূল্যবান কিছু ভাবা শুরু হলো, সৌন্দর্য চলে গেলো পুঁজিবাদীর হাতে।
তখন থেকে আলোচনা হলো কেবলই, "হিউম্যান বিউটি" নিয়ে।
অর্থাৎ, মানুষই যেনো সৌন্দর্যের একমাত্র ধারক ও বাহক হওয়ার যোগ্যতা রাখে। "আশরাফুল মাখলুকাত" বা সৃষ্টির সেরা জীবের খেতাব পেয়ে যাওয়া আমরা কেবল আমাদের মধ্যেই সৌন্দর্য্যকে সংকুচিত করে ফেললাম।
আমাকে সুন্দর হতে হবে, তাই বাগানে ফুল লাগাবো ভিন্ন কোনো কারণে লাগাবোনা। আমাকে দেখতে সুন্দর লাগবে তাই যাবতীয় প্রসাধনী বাজারের প্রসার ঘটতে লাগলো।
অথচ, প্রকৃতির মধ্যে সুন্দরতম জিনিসের একটি বাগানের ফুল তাই ফুলগাছ লাগাবো। এভাবে কিন্তু আজকাল কেউ ভাবেনা।
নিজের খোপায় লাগাবে, গেটে লাগাবে, বিছানায় লাগাবে, গাড়িতে লাগাবে - যাতে আমাদের সুন্দর দেখায়।
ফুল লাগানো হয়, এখন একটি ব্যবসায়ীক চিন্তার অংশ হিসেবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শব্দটা এখন কেবল টুরিস্ট গাইডবুকের অংশ। প্রকৃতিকে সুন্দর রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমাদের মধ্যে নেই, বরং একটি সুন্দর জায়গাকে কিভাবে মানুষের কাছে আরোও আকর্ষণীয় করে তোলানো যায় সেই চিন্তার বেজ থেকেই আমরা কোনো একটা প্লেসকে সুন্দরের তকমা দেই।
পোস্ট রোমান্টিক এরাতে সৌন্দর্য চলে গেলো পুঁজিবাদীর হাতে। আর আমরা আবারও পা রাখলাম বস্তুবাদে। সৌন্দর্য এখন আর eyes of the beholder এর মতো সামান্য জিনিস না। এটা এখন বিশাল ব্যাপার! এতটাই বিশাল যে, আমাকে সুন্দর হতে হবে তোমার চোখের মতোন করে। তোমার বেঁধে দেয়া কিছু স্ট্যান্ডার্ড মেনে।
এই ব্যাপারটা খারাপ।
সুন্দরকে কুৎসিত বানিয়ে ফেলা এই আমরা, সৌন্দর্য খুঁজতে যাই বস্তুর পরিমাপে।
... ... ...
তারিখঃ ১২০২/৬০/৭০
লেখাঃ রোড নং ছত্রিশ


No comments