যেভাবে কর্পোরেট মুক্তি পেতে হয়
... ... ...
- "চাকরিটা পেয়েছিস অসিম?
অবশেষে পেয়েই গেলি তাহলে! ইনশাআল্লাহ!
হবে হবে, এবার ঠিকই হবে সবকিছু ভালোভাবে।
রিটায়ার্ডে যেতে পারি আমি কি বলিস?
তোর কিছু একটা হওয়ার অপেক্ষাতেইতো ছিলামরে অসিম এতটা বছর। যাই সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে আসি।"
.
ফরেনারের আসা যাওয়া হয় কিনা! তাই মাথার উপরে ৩টা এসি আর পায়ের নিচে কাঠের ফলস ফ্লোর!
ওদিকে ডেস্কে নতুন ল্যাপটপ আর প্রেয়সীর দেয়া ক্যাকটাস রাখা, চশমাটাও।
নতুন অফিস।
ফাইলের কেবিনেট ফেলে দুইকদম দূরে চায়ের কাপ, চাইলেই আরাম আরাম চেয়ারে ঘুরপাক খেতে খেতে হাত বাড়িয়ে নেয়া সম্ভব,
তবু তা পিওন এসে রোজ নিজ হাতে দিয়ে যায়।
প্রতিবার অফিসে ফরেনার এলেই শুভেচ্ছাস্বরুপ পাই নতুন দেয়াল ক্যালেন্ডার।
কখনো ৪টায়, কখনোবা ৫টায়, ছুটি হলে একা হাটি রাস্তায়।
রাস্তা পেরোলেই মস্ত দালান।
ডানে ওয়েস্টিন, বায়ে গুলশান।
কি বিশাল এই শহর, আমার চাকরি, আমার ক্যারিয়ার।
রিটায়ার্ড নেবে? নিয়ে নাও। এইদিনের অপেক্ষাতেই তো ছিলে।
ইডিয়ট! কিভাবে বুঝবি টাকাটা কিভাবে আসে?
রাস্কেল! সারাদিন গল্পের বই, কেনো কারেন্ট এফেয়ার্সটা পড়া যায়না?
আজ থেকে অসিমের ভাত বন্ধ, সে যেনো কামাই করে খায়!
কত শাসন, বিনাকারণের ক্রোধ, কেনো হইনি প্রথম কিংবা গোল্ডেন কেনো ছুটলো!
সবকিছুইতো এই একটা চাকরির জন্যেই তাইনা? নিয়ে নাও, রিটায়ার্ড...
যাও, শান্তিতে টিভির রিমোটটা হাতে নাও।
... ... ...
- "অসিম, পেয়েছিস চাকরিটা?
আলহামদুলিল্লাহ, আমি জানতাম, একদিন তুই অনেক বড় হবি!
জানতাম একদিন এসিরুমেই যাবি। আমার কথা তখন মনে থাকবে?
এইদিনটার স্বপ্নই তো দেখেছি কত বছর। এবার আমার স্বপ্নের বাড়িটা হয়েই যাবে বল?"
.
জবাবে বলিনি-
ইন্টার্ভিউ বোর্ডে একবারও জানতেও চায়নি তোমার অসিম ক'টা ডিবেট জিতেছে, ক'বার টিভিতে দেখিয়েছে, ক'বার পত্রিকায় নাম এসেছে?
যেসব নিয়ে তুমি কতইনা আগ্রহে থাকতে,
- "জানেন ভাবী? আমার ছেলেটা না..."
কবে পাশের বাসায় নতুন কেউ আসবে, তাকে শোনাতে।
একবারো উলটেও দেখেনি সিজিপিএ কত ছিলো, (না উল্টেছে, সার্টিফিকেট অরিজিনাল কিনা চেক করতে)
ব্যাকলগ কটা খেলাম কিংবা পূর্বের চাকরি?
যা নিয়ে কতবার ঝগড়া হয়েছে বাবার সাথে।
জানতেও চায়নি আমার রাতজাগা গবেষণাপত্রগুলোর কোনো Abstract,
কিংবা নিতান্তই আমরা কয় ভাই-বোন?
এরপরেও যাইহোক, চাকরিটাতো হলো।
এবার ঘুমের ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পড়ো। আশেপাশের সব যে মিথ্যা, সব যে বানোয়াট আভিজাত্য তা টের পেয়ে গেছি।
এবার টাকা বাঁচানো বন্ধ করো। তোমার জানার প্রয়োজন নেই, কিভাবে চাকরি হয়।
কিভাবে রোজ ইন্টার্ভিউয়ের নামে কতো গল্প পড়ানো হয়।
আমারটাই কেবল বলি, শুয়ে শুয়ে শুনো,
ED জানতে চাইলো ক্যারিয়ার কিভাবে সাজাতে চাই? বেতন-ভাতা কত চাই? কি সুবিধা নিতে চাই?
কোনো ভ্রান্ত হয়রানি ছিলোনা। ছিলোনা মেকি গম্ভীর পরিবেশ। সোজাসাপ্টা আলাপেই, আমাকে মেপে নেয়া শেষ।
ও হ্যা, HR বলেছিলো, "হাতের লেখা সুন্দর।"
কিন্তু, এতদিন আশেপাশের ওরা যে কিসব বলতো!
ওরা বলতো, ইন্টার্ভিউ জমেরা নেয়।
ওরা বলতো, ইন্টার্ভিউ ভিন্ন ভাষাতে নেয়।
ওরা বলতো, ইন্টার্ভিউ সিভি দেখে নেয়।
আমি ভাবতাম, ইন্টার্ভিউ মনুষত্ব থেকে বাকিসব ছেঁকে নেয়।
বাস্তবে, সব উলটা! সব...
যাক, ঘুমিয়ে গেছো তাহলে এরই মাঝে। ঘুমাও, অনেকরাত ঘুমাওনি তুমি।
... ... ...
- "কি বলো, সত্যিই জব হয়ে গেছে তোমার?
তাহলে ক্যারিয়ারের শুরু করেই দিলে!
আল্লাহ, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা ভাইয়া!
কিন্তু তুমি চলে গেলে আমায় ফিজিক্স বোঝাবে কে?
গতির সূত্রগুলো আর ওদিকে হায়ারম্যাথের ফাংশন চ্যাপ্টারটা?
বলেছিলে, পরে ধরবে।"
.
ক্যারিয়ারের কথায় মনে এলো, কখনো আমি কোথাও ঘুরতে যাইনি।
কফিশপে নাকি নতুন বন্ধু মেলে, এই ভয়ে সেদিকে তাঁকাইনি। যেতাম না তো আগেও!
সেমিস্টার ব্রেকে সবাই যেবার রাতারগুল গেলো, আমি টিউশনির অযুহাতে নিজেকে রেখেছিলাম বাসাতে।
সবাই সকালে ক্লাস করতো, আমি থাকতাম ঘুমিয়ে।
বরাবরই এই একা থাকতে অভ্যস্থ আমিকে নিয়ে, একা এই শহরে আসাটা আমার কাছে নতুন লাগছেনা।
বরং অনেকের সাথে মিথ্যা পরিচিতির আলাপকালেই যত জ্বালা।
তোকে আর এত অল্প বয়সেই বুঝতে দিতে চাইনা-
ওরা অসিমকে দেখেনা, দেখে কড়া আয়রন করা শার্ট।
ওরা অসিমকে শোনেনা, শোনে পজিশন আর সেলারি ইনক্রিমেন্টের হার।
ওরা আমাকে বুঝেনা, বুঝে মানিব্যাগের নোট আর দেয় উপরি মিথ্যা সালাম।
তবে এই বুঝি ছিলো ক্যারিয়ার?
সে যাইহোক, তোকে কিন্তু গোল্ডেন পেতে হবে।
হতে হবে ক্লাসের প্রথম, পড়তে হবে রোজ কারেন্ট এফেয়ার্স।
আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি, তুই হবি ডাক্তার...
উহু, প্রশ্ন করিসনা এভাবেই সব আগে থেকে ফিক্সড থাকে।
তোকেও জানতে হবে কিভাবে ঘরে টাকাটা আসে,
জানতে হবে কেনো ভাইয়ের সাথে বাবার ঝগড়া হতো।
তার আগে জানতে হবে ফিজিক্সের গতির সূত্র
আর হায়ারম্যাথের ফাংশন চ্যাপ্টার।
- "আচ্ছা, আমি একটা টিচারের ব্যবস্থা করবো।"
... ... ...
- "এখন তাহলে আসি? দোয়া করিও আমার জন্য তোমরা।
আমার বাস ১১টা ৩৫, হ্যা হ্যা পৌছেই জানাবো।
হ্যা, রোজ গোসল করবো। নিয়মিত খাবো।
হ্যা হ্যা, নামাজটা পড়বো। কল দিবো।
হ্যা হ্যা হ্যা, সবকিছু ওকে আছে, এবার তবে যাই?"
আমি অসিম বাসাটা ছেড়েছি সেদিনই, যাতে মুক্তি দ্রুত পাই!
... ... ...
তারিখঃ ২১/৯০/১২০২
লেখাঃ রোড নং ছত্রিশ.


No comments