আয়নামহল - পর্ব ০১


 

- "ভাই...ও ভাই...শুনছেন ভাই?...ভাই..ও ভাই..."

ধৈর্য ধরে একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে ছেলেটা। কচ্ছপ প্রকৃতির এই ছেলেটির নাম এন্টোন। পুরো নাম এন্টোন ক্লে। ৯বছর বয়সী এক মেয়েকে রেইপের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত।  আমার নতুন সেলমেট।
এ মুহুর্তে যতক্ষণ আমি চোখ মেলে না তাঁকাবো, এন্টোন এভাবে ক্ষীণস্বরে ডেকেই যাবে!

আমি রাশেদুল চৌধুরী রাশেদ।
আমার ইউনিফর্ম নং: 198114D
আমার উপর অভিযোগ: রহস্যজনক কারণে নৃশংসভাবে স্ত্রী কে খুন. নিউ ডেকোটার সেন্ট্রাল কয়েদখানায় আঁটকে আছি।

সে যাহোক, চোখ মেলে জানতে চাইলাম, 'ডাকছে কেনো?'
এন্টোন বললো, "মারিও ইভ" নামের এক মহিলা দেখা করতে এসেছে নাকি।

একটু অবাক হলাম। মারিও হলেন একজন এন্টিক কালেক্টার। আমার কোন আত্মীয়া নন, তবু যখন পাস ক্লিয়ারেন্স বের করে এখানে এসে পরেছেন, নিশ্চয়ই জরুরি কিছু।
দেখা করতে গেলাম...

রুমে এসে দেখি মারিও চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। রাতে কি ঘুম হয়নি? যাহোক, গলা খাঁকারি দিলাম।

- 'হ্যালো রাশেদ, কেমন আছো?'
- 'জ্বী খারাপ। আপনি?'
- 'এই আছি কোন রকম'
- 'তো হঠাৎ এখানে,,, কিছু কি হয়েছে?'

দেখলাম প্রশ্নটার উত্তর দিতে তিনি ভাবছেন। হয়ত অনেককিছু বলবেন তিনি, একটু গুছিয়ে নিচ্ছেন।
তারপর তিনি যা বললেন তা শুনার জন্য মোটেও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না!

... ... ...

তাহলে শুরু থেকেই বলি।
সংক্ষেপে বলতে গেলে আমার আয়নামহলের কাহিনিটা এরকম:

১৫ই জুলাই, ২০০৭.
কথা বলছিলাম মারিও ইভ নামের এক এন্টিক কালেক্টর এর সাথে। ভদ্রমহিলা হাত নেড়ে আগ্রহের সাথে গল্পটা আমায় শুনাচ্ছিলেন,

- "ঘটনার শুরু হয় গতবছরের শেষের দিকে। আমি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাবো।
সবে রুমের লাইট বন্ধ করে শুয়েছি, অমনি ধপ করে সামনের রুম থেকে ১টা শব্দ এলো। একটু পরে আবার! প্রথমে ভেবেছিলাম বিড়াল হবে হয়ত। কিন্তু আস্তে আস্তে ধুপ ধুপ শব্দটা একটা বাজনায় পরিণত হলো, যেনো ধীর কিন্তু গুরুগম্ভীর লয়ে একদল জংলী ড্রাম বাজাচ্ছে আমার রুমে।
যেহেতু রুমে আমি একা, তাই প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই... যিশুখ্রিস্ট এর নাম পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই।

ঘুম ভাঙলো এলার্ম এর শব্দ শুনে, এবং ঘুম ভেঙে রিতিমত ভড়কে যাই। রাতের সেই ধুপ ধুপ আওয়াজটা এখনো হচ্ছে...
সাহস করে সামনের রুমে গিয়ে, লাইট জ্বালিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে থাকি।
তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি কি দেখেছি!

দেখি আমার ঐ পুরাতন আলমিরায় আয়নার অংশটুকুতে, লিলিপুটের মত ছোট ছোট একদল মানুষ ড্রাম বাজিয়ে উল্লাস করছে আর ড্রাম ঘিরে নৃত্য করছে!
যেনো আমার আলমিরায় বিরাট কোন কালার টেলিভিশন সেট করা হয়েছে, এবং সেখানের চ্যানেলে আমি এক মজার শো দেখছি!

চোখের ভুল ভেবেছিলাম, তাই আরেকটু এগিয়ে যাই। তখনই আমার উপস্থিতি তারা টের পেলো, এবং বাজনা বন্ধ করে একসাথে আমার দিকে ফিরলো! তাদের অদ্ভুত রকমের চাহনি আর উজ্জ্বল কমলা রঙের চোখ দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি...
সকাল ৮টার দিকে আমার জ্ঞান যখন ফিরে, আমি নিজেকে আমার বিছানায় আবিষ্কার করি।

ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং না???
কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমার আলমিরার সামনে..."

এতক্ষণ যাবত তিনি যে কাহিনি শুনালেন সেটা যে পুরোটা বানোয়াট তথা মুখরোচক তাতে কোন সন্দেহ নেই!
কথা আর না বাড়িয়ে বললাম,

- 'কত চান আপনি এই ভাঙা আলমিরাটার জন্য?'
- 'আমার ঘটনা শুনার পড়েও তুমি এটা কিনতে চাও?'
- 'জ্বী চাই,,,'
- 'তবে তোমাকে এর জন্য ১৫০০$ দিতে হবে!'
- 'ক্ষেপেছেন নাকি?,,এই ময়লার ডিপোর জন্য আমি আপনাকে খুব বেশি হলে ৩০০$ দিতে রাজি আছি...'

যাহোক, শেষমেশ ৮০০$ ডলার খসিয়ে ১৮০০শতকের পুরাতন এই আলমিরাটা কিনলাম।

আমার স্ত্রী রাকা, গোলগাল চেহারায় চশমা পরিহিতা এক অদ্ভুত মেয়ে। তাবৎ দুনিয়ার যাবতীয় হাবিজাবি জিনিসে তার আগ্রহের কমতি নেই। এই আলমিরাটা তার অদ্ভুত আবদারগুলোরই একটি। বলেছিলাম এবার হ্যালোয়িনে তাকে চমকে দিবো!

হ্যা, রাকা আলমিরাটা দেখলে সত্যিই চমকে যাবে...
.
.
নর্থ ডেকোটার, টুয়েলভ এভিনিউ এর ছোট্টখাট্টো একটা ফ্লাটে থাকি আমরা।
আমি এখানকার এক কসাইখানাতে কাজ করি। সারাদিন ছুরি-চাকু নিয়ে থাকতে থাকতে মাত্র তিনমাসেই যন্ত্রমানব হয়ে গিয়েছি। অথচ এখান থেকে একবছর আগেও আমার এ অবস্থা ছিলোনা।
সেইদিনগুলোর কথা ভাবলে আজোও স্বপ্নের মত লাগে সব

যখন প্রথম আমেরিকায় এসেছিলাম স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে, দেয়ালে দেয়ালে রঙিন ছবি আর স্ট্রিট ল্যাম্পগুলোর নিচে মিনিস্কার্ট পরিহিতা তরুনীদের দেখে সত্যিই ভুলতে বসেছিলাম, গ্রামবাড়ির জমি বিক্রির টাকায় এখানে এসেছি আমি, উপার্জনের আশায়! চাকরির বিনিময়ে রোজ জুটেছিলো হতাশা, আত্মবিরোধ।
এখনো মনে আছে ডাউনটাউনের পাশের পার্কে বিকেলবেলা কাঁদছিলাম আমি। দেশের বাড়ি তে টাকা পাঠাতে পারছিনা, নিজে খেতে পারছিনা। রাকার সাথে সেখানেই পরিচয়..

পৈত্রিকসূত্রে রাকা বাঙালী হলেও ওর জন্ম, বেড়ে ওঠা এই আমেরিকাতেই। রাকা তখন মাত্র হাইস্কুল পাস করেছিলো। সেই বিকেলে পরম মমতায় অভয়ের সাথে হাত ধরেছিলো আমার, আজোও সেভাবেই রয়েছে!

পরপর অনেককিছু ঘটেছে।
এই বেকার ছেলেটার হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলো মেয়েটা নিজের আলিশান বাড়ি ছেড়ে। আজ ৩মাস হলো আমি নতুন চাকরীটা পেয়েছি, সেই বেতনের টাকায় নতুন ফ্লাটে উঠেছি। দেখতে দেখতে কতকিছু হয়ে গেলো রাতারাতি..

- 'রাশেদ, তুমি এসেছো?'
- 'হু'
- 'এত দেরি করলে যে,,,আমার চিন্তা হচ্ছিলো খুব'
- 'পথে একটু ঐ এন্টিক শপটায় নেমেছিলাম তো তাই'
- 'কেনো? ওখানে কি!'
- 'এদিকে আসো আগে তারপর বুঝবে কেনো দেরি হলো,,,'

ভারী কাঠের আলমিরাটা দেখে রাকা শুধু চমকায়ইনি, সাথে সাথে চেহারাটা মলিন করে ফেলেছে।

- 'রাকা, তুমি কি খুশি হওনি?'
- 'শুধু শুধু কেনো কিনতে গেলে এটা! আমিতো মজা করেছিলাম!,,,দেখি ক্যাশ মেমোটা?,,,৮০০$!!,,রাশেদ, তুমি কি পাগল?'
- 'হু আমি পাগল!'
- 'হু বুদ্ধু একটা! আমি জানি তুমি আমায় চমকে দিতে চেয়েছিলে'
- 'তুমি কি চমকাও নি!'
- 'উহহু,,,মোটেও না,,,,হিহিহিহি,,,এই এখানে দাড়িয়ে বকবক করলে চলবে? ফ্রেশ হয়ে নাও'
- 'হু খুব ক্ষুধা পেয়েছে খেতে দাও!'

রাশেদ আর রাকা ভিতরে চলে গেলো। আলমিরাটা রয়ে গেলো বারান্দায়...
.
.
সেদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ই ধুপ ধুপ আওয়াজ শুনতে পাই। ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি সেটা ঐ আলমিরা থেকে আসছে। তাই পাত্তা না দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম...

মাঝরাতে হঠাৎ রাকার ধাক্কায় ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বস। রাকা ভয়ার্ত স্বরে বললো,

- 'বাড়িতে চোর এসেছে'
- 'মানে?'
- 'আমি ধুপ ধুপ আওয়াজ শুনতে পেয়েছি!'
- 'আরে এলার্ম সিস্টেম এক্টিভেট করা আছে তো'
- 'না,,, আমি নিজে ধুপ ধুপ শব্দ শুনেছি,,,একটু চুপ করে অপেক্ষা করো, তুমিও শুনবে'

সেই সময় বারান্দা থেকে গুরুগম্ভীর লয়ে ড্রামের আওয়াজ আসতে লাগলো। চমকে উঠলাম আমি। রাকা আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।

কিসের আওয়াজ এটা?
বিছানা থেকে নেমে বারান্দার দিকে গেলাম। আওয়াজটা বারান্দায় রাখা আলমিরা থেকেই আসছে। নিশ্চয়ই ভিতরে ইঁদুর আছে। ডোর নব ঘুরিয়ে বারান্দায় আসতেই শব্দটা থেমে গেলো। সবকিছু ঠিক আছে দেখে দরজা লাগাতেই ফের শব্দটা শুরু! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি বারান্দায় যেনো একদল জংলী ড্রাম বাজাচ্ছে।
আস্তে করে দরজা খুললাম, পা টিপে টিপে আলমিরার সামনে গেলাম। আলমিরার সাথে লাগানো আয়নার দিকে চোখ পড়তেই জমে গেলাম..

খুব বেশি হলে ৩ইঞ্চি হবে সাইজে।
ওগুলাকে মিনিসাইজের মানুষ বলব কিনা বুঝতে পারছিনা...এক দল হয়ে উন্মত্তের মত ড্রাম বাজাচ্ছে, আরেক দল ড্রাম ঘিরে নাঁচছে। এ যেনো আদিম কোন সভ্যতার উন্মাদাগার অংশ! মারিও ইভের কথা মনে পরলো...ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে না! পা টিপে টিপেই ফিরে এলাম।

এই ঘটনা রাকাকে জানানো যাবেনা। ভয় পাবে। তাই ফিরে এসে বললাম,

- 'আরে কিছুনা,,,ঘুমিয়ে পর,,,কাল সকালে দেখা যাবে'

এই বলে রাকাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

যদিও নিজে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তাহলে কি ঐ মহিলার কথাই ঠিক?
আলমিরাটা কি আসলেই ভুতুড়ে??
নাকি পুরোটাই চোখের ভুল বা হ্যালুসিনেশন???
আমাকে আরেকদিন দেখতে হবে..
... ... ...

আমি সে রাতে বুঝতেই পারিনি, কি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!





(চলিবে)
... ... ...

পর্ব ০১.
তারিখঃ ৫১০২/০১/৮২!

No comments

Powered by Blogger.