বাবলির রসুইগাছ
আজ বাবলির জন্মদিন।সকালবেলা রিমঝিম আপু এসে বাবলিকে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
সুন্দর ১টা পরীর মত লাগছে আজ বাবলিকে। রিমঝিম আপু যাওয়ার সময় বাবলিকে বলেছে, যদি বাবলি বেশি কথা বলে তাহলে তার জামার সাথে লাগানো আলগা পাখাটা সত্যি সত্যি পাখা হয়ে যাবে। তখন পরীরা দল বেধে এসে তাকে পরীদের দেশে নিয়ে যাবে।
তাই বাবলি এখন একটু দ্বিধায় আছে, তার কি চুপ করে মানুষ হয়ে থাকা উচিত? নাকি বেশি বেশি কথা বলে পরী হয়ে যাওয়া উচিত?
আচ্ছা পরীর দেশের বাচ্চা পরীগুলো কি তাদের জন্মদিনে মিথ্যেকারের মানুষ সেজে বসে থাকে? তারাও কি বেশি কথা বলে বলে পরী থেকে মানুষ হয়ে যায়?
বাবলির খুব ইচ্ছা করছে রিদ্ধু চাচ্চুকে গিয়ে প্রশ্নগুলো করতে। বাবলির মতে রিদ্ধু চাচ্চু পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ যে সব প্রশ্নের উত্তর জানে। কিন্তু বাবলি চুপ করে আছে।
সে ঠিক করেছে একদম কথা বলবেনা। বাবলি চায় না যে পরীরা তাকে নিয়ে যাক!
.
.
বাবলিকে আজ কেউ বকা দিচ্ছেনা।
আম্মুর সাথে রান্নায় সাহায্য করতে গিয়ে বেখেয়ালে ৩টা ডিম ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু আম্মু বকা দেননি। আব্বুর চশমাটা এগিয়ে দেয়ার সময় চশমার ডাঁটি ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু আব্বুও বকা দেয়নি।
বাবলির খুব ফুরফুরে লাগছে। ইস, জন্মদিনটা যদি প্রতিদিন হতো!
আচ্ছা, প্রতিদিন জন্মদিন হয়না কেনো?
কারণ, প্রতিদিন জন্মদিন হলে আর বিশেষ কোন মজা থাকতনা। হুমম, বিজ্ঞের মত মাথা নাড়তে নাড়তে সে ছাদের উপর গেলো।
বাবলির ছোট্ট ফুলের বাগান আছে ছাদের উপর।
বাগানে ২টা ক্যাকটাস আর ১টা মরিচের গাছ আছে। কিছুদিন আগে রিদ্ধু চাচ্চু তাকে ১টা নতুন ফুলগাছ এনে দিয়েছে। বাবলি গাছটা চিনেনা, গাছে কোন ফুলও নেই। তবে রিদ্ধু চাচ্চু বলেছে বিশেষ ধরনের ফুলগাছ এটি, যত্ন করে রাখলে তবেই ফুল ফুটবে! কিন্তু বাবলি জানেনা, বিশেষ ভাবে যত্ন নিতে হয় কিভাবে।
তাই সে রোজ এই সময়ে ছাদে উঠে গাছটাকে গল্প শোনায়, কবিতা শোনায়।
তার এই বিশেষ গাছটার ১টা বিশেষ নাম আছে, "রসুঁই".
- 'হ্যালো রসুঁই, How are you?' 'তুমিকি জানো How are you মানে কি?, এটার মানে তুমি কেমন আছো?...কেউ How are you বললে তোমার বলা উচিত I am fine. And you?...এটার মানে হলো, আমি ভালো আছি। কিন্তু And you? মানে আমি জানিনা...'
- 'রসুঁই পানি খাবা? আজ তোমাকে বিশেষ পানি খাওয়াবো,,,জমজম কুপের পানি,,,এই পানি খেলে কোন অসুখ হয়না, পাতা পরে যায়না, তুমি বড় হয়ে যাবে'
- 'রসুঁই জানো আজ কেনো এই বিশেষ পানি দিচ্ছি?...কারণ, আজ বাবলির জন্মদিন। আজ বাবলি তোমাকে বেশি বেশি আদর করবে'
এরকম নিজে নিজেই কথা বলছি বাবলি।
এরপর হুট করে বাবলি পিছনে ঘুরলো। মনে হলো, ছাদে আরোও কেউ আছে।
কিন্তু বাবলি জানে ছাদে এখন কেউ থাকার কথা না, সবাই নিচে ব্যস্ত। তাহলে, শব্দ হলো কিসে??
বাবলির ভয় করছে। যদিও রিদ্ধু চাচ্চু বলেছে সব ভুতেরা দিনেরবেলা ঘুমাতে যায়। তাই যতটা কম ভয় পাওয়া যায় সেই চেষ্টা করছে বাবলি এখন। আর আস্তে আস্তে সিড়ির দিকে যেতে চাইলো।
এবং ঠিক তখনই বাবলিক জিনিসটাকে দেখতে পেলো!
সবুজ রঙের ফ্রক পরা ১টা মেয়ে তার দিকে তাঁকিয়ে হাসছে। ফ্রকটা হুবহু বাবলির মত, তবে পিঠের নকল পাখাদুটো বড় আর ও দুটো নড়ছে। বাবলি জানে, এটা ১টা আকাশপরী!
.
.
সময় তখন বিকাল সাড়ে ৪টা.
বাবলিদের বাড়িতে কান্নাকাটির ধুম পরেছে। বিগত ৪ঘন্টা যাবৎ বাবলি নিখোঁজ। বাবলির বাবা সিদ্দিকুর আমিন সাহেব অফিস থেকে চলে এসেছেন।
'শেষবার বাবলিকে ছাদে উঠতে দেখেছি'
- ভয়ার্ত স্বরে জানালো রিমঝিম।
- 'তোমরা জানতেনা, বাবলি অসুস্থ! রোদে যাওয়া ওর নিষেধ!! আঁটকালেনা কেনো তোমরা?,,,মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়!!!'
কান্নারচোট আরোও বাড়িয়ে দিলেন বাবলির মা।
'এভাবে বলোনা গো!,,,,মেয়েটা আমার কোথায় গেলো!!'
বাড়ির কাজের মেয়ে বিন্তিও ফিঁচফিঁচ করে লোকদেখানো কান্না কাঁদছে। যেখানে বাড়ির বড়রা কাঁদছে সেখানে শুকনো চোখে দাড়িয়ে থাকাটা ভারি অন্যায়!
রিদ্ধু ভার্সিটি থেকে চলে এসেছে খবর পেয়ে। দাঁড়িয়ে আছে ছাদের উপর। সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা, ছাদে এত প্রজাপতি এলো কিভাবে! বাবলির বাগানটাতেও ছোট ছোট সাদা মরিচের ফুল ধরেছে, ক্যাকটাসে ধরেছে গোল গোল কাঁটাময় হলুদ ফুল। তবে পাশে "রসুঁই গাছটা" নেই, সেখানে পরে আছে খালি মাটিভর্তি টব।
বাবলির সাথে সাথে বাবলির প্রিয় রসুঁই টাও উধাও...
.
.
সন্ধ্যাবেলার একটু আগে আগেই স্বাভাবিকভাবে বাবলি ছাদ থেকে নেমে এলো। নিচে এসে বাড়ির সবার দিকে তাকিয়ে সে ভড়কে গেলো, আজ নিশ্চয়ই আম্মু তাকে মারবে!
সে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, সবুজফ্রক পরা এক আকাশপরী এসে তাকে পরীদের দেশে নিয়ে গিয়েছিলো। সেখান থেকে আসতে আসতেই এই দেরীটা হলো। রিমঝিম আপু দৌড়ে এসে বাবলিকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। বাবলি বুঝছেনা এখানে এত কান্নার কি আছে?
... ... ... ...
(ঘটনার সপ্তাহখানেক পর...)
বাবলির রুটিন চেকআপের ডেট আজ। ডক্টরের কাছে যেতে হবে।
বাবলি জানে, ওর শরীরের রক্তে কি একটা যেনো নেই। তাই প্রায়ই তাকে ডক্টরের কাছে যেতে হয়। তবে বাবলি যেটা জানেনা তা হলো, বাবলির রক্তে লোহিতকণিকা তৈরির হার মাত্রাতিরিক্তভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ডাক্তাররা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পথে আসতে আসতে ৮ম বারের মত আম্মুকে আকাশপরীর ঘটনাটা শুনাতে চাইলো বাবলি। কিন্তু সেই একই উত্তর,
- "বাবলি, এরকম মিথ্যা বলোনা তো! চুপ করো"
আম্মু কিছুতেই বুঝতে পারছেনা, বাবলি মিথ্যা বলছেনা। বাবলি মিথ্যা বলতে শিখেনি আজোও!
প্রতিবারের মত এবারও ডক্টর সুঁই ফুটিয়ে এতগুলো রক্ত নিয়ে চলে গেলেন।
বাবলি চুপ করে বিছানায় শুয়ে আছে। সামনের তাকে রাখা টিভিতে তখন কার্টুন হচ্ছে। বারবি-ডল গুলোর কাহিনী দেখে বাবলির খুব হাসি পেলো। ওরা কত বোকা! আকাশপরীর দেশটা এরকম হয় নাকি? উহহু, বাবলি দেখেছে সেই দেশটা কত সুন্দর।
তাকে আকাশপরী বলেছে, খুব জলদিই বাবলিকে ফের ওখানে নিয়ে যাবে।
বাবলিকে মুখ টিপে হাসতে দেখে আম্মু চোখ পাঁকালো!
কিন্তু বাবলি অন্যদিকে ফিরে হাসতেই লাগলো.
.
.
বাবলির শরীর দিনদিন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। বেশ কদিন ধরে স্কুলেও যেতে হচ্ছেনা!
তাতে অবশ্য সমস্যা নেই, বাবলি বাড়িতেই আনন্দ করে বেড়ায়। কিন্তু আজকাল আর এক দৌড়ে সিড়িবেয়ে ছাদে যেতে পারেনা বাবলি, মাঝপথেই হাফ ধরে যায়!
রিদ্ধু চাচ্চুকে ব্যাপারটা জানাতে হবে!
এদিকে বাড়ির প্রতিটা মানুষের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
ডক্টর লাস্ট চেকাপের দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরওয়ালাকে স্মরণ করতে বলেছেন। They've nothing to do!
.
.
.
আজ বাবলির খুব খুশি খুশি লাগছে। কারণ বাড়িতে দাদু, নানু, ফুফি সবাই এসেছে তাকে দেখতে.
কিন্তু বাবলি বিছানা থেকে মোটেও উঠতে পারছেনা। তার মাথার ভিতরে ভো ভো করছে। শেষবার, শিশুপার্কে দোলনার ঘোরার পর এমন ভো ভো করেছিলো!
কিন্তু বাবলি বুঝছেনা, সবাই ওকে দেখতে এসে কান্না করছে কেনো? সবার কান্না দেখলে, বাবলির কান্না পায়না বুঝি?
রিদ্ধু চাচ্চু বলেছে, কাদলে নাকি বাবলিকে মোটেও সুন্দর দেখায় না। তাই বাবলি ছলছল চোখ নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে!
বাবলি চায়না, এতদিন পর সবাই দেখতে এসে পঁচা বাবলিকে দেখুক.
... ... ...
বিকেল নাগাদ বাবলির অবস্থা আরোও খারাপ হয়ে যায়। হাত পা রক্তশূণ্য হয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য কোন পিশাচ যেনো স্ট্র দিয়ে টেনে টেনে বাবলির শরীরের সমস্ত রক্ত চুষে নিচ্ছে!
বাবলির দাদু কোরআন শরীফ নিয়ে টেনে টেনে পড়ছেন। আর নানু পাশে বসে কিসব দোআ পড়ে পড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কাজের মেয়ে বিন্তিও মনে মনে ঠিক করেছে, বাবলি সুস্থ হলে সে চুরি করা ছেড়ে দিবে।
এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ বাবলি রিদ্ধু চাচ্চুকে ডাক দিলো।
রিদ্ধু এসে চেয়ার টেনে বসলে বাবলি রিদ্ধুকে কানটা কাছে আনতে বলে ফিসফিস করে কি যেনো বলতে শুরু করলো।
অনেকক্ষণ ফিসফিস করার পর বললো,
- "চাচ্চু তুমি আমার রসুঁইকে দেখে রাখবা, ঠিকাছে?"
রিদ্ধু কিছু বললো না, চোখের কোণটা মুছতে মুছতে মাথাটা কাত করে সায় দিলো।
বিনিময়ে বাবলি স্মিত একটা হাসি দিলো, যে হাসিতে প্রাণোচ্ছলতার বিন্দুমাত্র অভাব নেই.
.
.
মাগরিবের আজানের ১৫-২০মিনিট আগেই বাড়িতে কান্নার রোল পরে গেলো। আমিন সাহেব পারলেন না, তার সর্বোচ্চ দিয়ে মেয়েটাকে আগলে রাখতে।
রিদ্ধু তখন ছাদে বাবলির ছোট্ট বাগানটার সামনে দাড়িয়ে আছে। বাগানে ২টা ক্যাকটাস, সাথে বাচ্চা ১টা ক্যাকটাস. মরিচ গাছে কেবল ১টা মরিচ ধরেছে। সবকটা গাছে ফুল ফুঁটে রয়েছে।
রিদ্ধু হাত বাড়িয়ে বাবলির রসুঁই গাছের টবটা নিলো। রসুঁইগাছে বড় বড় নীলফুল ফুটেছে অনেক।
ছাদে একসাথে এত প্রজাপতি রিদ্ধু আগে দেখেনি! নাহ, দেখেছে...বাবলির জন্মদিনের দিন দেখেছিলো।
হাতে রসুঁই গাছের টব নিয়ে রিদ্ধু গৌধুলির আকাশের দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে। আর বিড়বিড় করে আউড়াচ্ছে,
"ভালো থেকো আকাশপরীরা...ভালো থেকো. . ."
... ... ...
তারিখঃ ৫১০২/৯০/২০!

No comments