স্বচ্ছ সিরিজের - একমুঠো জোনাকিপোকা

মি দাড়িয়ে আছি একটা নাম না জানা মাঠের পাশে।
আশেপাশে কোন দোকানও নেই যে, বোর্ড দেখে জায়গাটার নাম জানতে পারবো!

বিজয় দিবস পালিত হয়ে গেছে গত ২দিন আগে। ঘুমিয়েই কাটিয়েছি দিনগুলো।
মেসে ঐদিন চাঁদা তুলে বিরিয়ানী রান্না হয়েছিলো। বলাই বাহুল্য, আমার চাঁদাটা বদরুদ্দীন সাহেব দিয়েছেন
আমার পায়ে নতুন জুতা। তিথীই গীফট করে পাঠিয়েছে। যেখানে আছি, পাশে একজন বস্তাবাবা শুয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্ট আছে পাশে, কিন্তু ল্যাম্পে আলো নেই।

আপাতত জোনাকি পোকা দেখছি দাড়িয়ে। অনেকগুলো জোনাকি।
এই ব্যস্ত শহরের মাঝে একসাথে এতগুলো জোনাকি দেখতে বেশ বেমানান লাগছে! ওগুলোর থাকা উচিত, শহর ছাড়িয়ে কোথাও কোন নিশ্চুপ এক বাগানের বেলিফুল গাছের নিচে। যেখানে গতকাল কিশোরী হাতে রোপিত হয়েছে ৩টা গোলাপ, টবে করে টাইমফুল আর বেশ কিছু মোরগ-ঠনঠনি!

১টা পলিথিন হলে বেশ হতো। জোনাকি গুলোকে পলিথীনে ভরে হাটতাম! আলোকিত মানুষের মত হাতে জ্বলতো পলিথিন ভর্তি জোনাকি।
আইডিয়াটা মন্দ না! আশেপাশে খুজলে নিশ্চয়ই পলিথিন পাবো। একটু খুজতেই পেয়ে গেলাম, তবে একটা কোণায় ছোট্ট ছিদ্র। যাহোক, একটা একটা করে জোনাকি ধরে ধরে পলিথিনে রাখছি।
মোটামুটি ১৫/১৭টার মতো হতেই মুখ আটকে নিলাম। হ্যা, এখন হাতে নিয়ে হাটা যায়।

হাটছি আমি মেইন রাস্তা দিয়েই। চোখে চশমা, গায়ে চাদর, গোড়ালি গোটানো প্যান্ট, পায়ে নতুন জুতা...আর হাতে এক পলিথিন জোনাকি। বেশ ফুরফুরে লাগছে। হাটতে হাটতে বেশ কিছুদুর এসে পরিচিত রাস্তা পেলাম। কাছেই দুর সম্পর্কের এক আত্মীয় আছে।
আবাসিক এলাকা, নাম- শান্তি নিকেতন. আমি হাটছি জি-ব্লক দিয়ে! হালকা কুয়াশা পড়েছে। আমার জোনাকির পলিথিনের গায়ে শিশির। এতরাতে এলাকার সবাই ঘুম, তবে কিছু কিছু বাড়িতে আলো জ্বলছে।

আচ্ছা, এই জোনাকিসমেত তিথীর বাসায় গেলে কেমন হয়? বেশ খুশি হতো ও এটা দেখে। তবে যেতে ইচ্ছা করছেনা।
হঠাৎ কে জেনো পিছন থেকে ডাক দিলো,

- 'এক্সিউজ মি, ব্রাদার!'

এতরাতে কাকে এক্সিউজ করব! ঘুরে দেখি, হলুদ পান্জাবী পড়া এক ছেলে। মাথাভর্তি চুল। আমার বয়সেরই মনে হচ্ছে! কাছে এসে ছেলেটা দাড়ালো।

- 'আচ্ছা এখানে ফার্মেসীর দোকান খোলা পাবো কোথায় বলতে পারেন?'
- 'কি দরকার?'
- 'কিছু ওষুধ কিনবো।'
- 'তো?'

বলেই সামনে হাটা শুরু করলাম। দেখি, ছেলেটাও সাথে সাথে আসছে। যদিও তাকে একবারোও বলিনি যে, ফার্মেসীতে নিয়ে যাবো। তবুও আসছে যখন হাটুক কিছুক্ষণ।

- 'ভাইয়্যা নাম কি?'
- 'স্বচ্ছ'
- 'সুন্দর নাম! আমি হিমু'
- 'রাতে পান্জাবী পড়ে হাটলেই হিমু হওয়া যায়?'
- 'এটাই বলবেন জানতাম। আসল নাম মুহিত, উল্টো করে "তহিমু"। হিমুর কাছাকাছি'
- 'আচ্ছা'
- 'ভাইয়্যার হাতে ওটা কি?'
- 'পলিথিন। তার ভিতরে জোনাকি।...দেখবে?'

বলে পলিথিনটা মুহিতের মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। ঝট করে একলাফ দিয়ে সরে গেলো। বিড়বিড় করে কিছু বললো।
আমি আমার মত হাটতে লাগলাম। তাকিয়ে দেখি ছোকড়া এখনও দাড়িয়ে আছে।
পাগল ভেবে ভয় পেয়েছে বোধহয়। ভালো...
এতরাতে কোন ফার্মেসী খোলা পাবো কিনা জানিনা, তবু মন বলছে পেয়ে যাবো।
কিছুদুর যেয়ে মোড় ঘুরে কিছু দোকান-পাট চোখে পড়লো অবশ্য। হ্যা, একটা ফার্মেসী পাওয়া গেছে।
আমি দোকানের সামনে গিয়ে দাড়ালাম।
একটু পর দেখি ছোকরা এসে গেলো, দোকান থেকে কিছু ওষুধ নিয়ে আবার ফিরে এলো।

আমি আবার হাটতে লাগলাম। আজ রাতে আর মেসে ফেরত যাওয়া বোধহয় হবেনা, সুতরাং বাইরেই কাঁটাতে হবে।
আমরা একটা ছোট ব্রীজের উপর এসে থামলাম। আমরা বলতে, ঐ ছোকরা সাথেই আছে এখনও তবে বেশ দূরত্ব রেখে রেখে। বললাম,

- 'বাসায় যাওনা ক্যান?'
- 'বাসা থেকে বের হয়ে গেছি। আর যাবোনা'
- 'ও...সুন্দর সুন্দর...তো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?'
- 'আপাতত আপনার সাথে থাকা। রাখবেন না?'
- 'রাখা যায়। তবে প্রতি ঘন্টা দশ টাকা করে। হাটতে হাটতে যদি কথা বলতে চাও, তবে আরোও এক্সট্রা ৫টাকা। টোটাল ১৫ টাকা ঘন্টাপ্রতি, রাজি?'

চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সম্মহিতের মত মাথা নাড়লো।

- 'বেশ চলো তবে'
- 'কোথায় যাবো আমরা?'
- 'আমরা এখন যাবো গান্জাবাবার কাছে...'

ব্রীজের নিচে নামলাম মুহিত ওরফে হিমুকে নিয়ে।
নিচে নেমে দেখি ব্রিজের এক কোণায় মাথা নিচু করে হনুমান টুপি পড়া এক লোক বসা। পাশে গিয়ে ভদ্রভাবে সালাম দিলাম।

- 'আসসালামু আলাইকুম ভাই'
- 'ওয়ালাইকুম আসসালাম। তয় চিনলাম না আপনেগোরে'
- 'আমি স্বচ্ছ আর ও হিমু'
- 'বড়ই সৌন্দর্য দুইখান নাম!...তো এখানে কি কাজ? স্টিক(উইড) এহনও আসেনাই, গুঁটি(ইয়াবা) আছে চলবো?'
- 'না। আপাতত কিছু লাগবেনা, আসলে আমরা এসেছি শুধু দেখতে। আপনারা খাবেন, আমরা নিয়ম দেখবো। তারপর অন্য একদিন খাবো!'
- 'ও...নুতান পাবলিক! এগুলা খাওন ভালা না। বাইত যানগা, শিখা লাগতোনা আপনেগো!'

চলে গেলাম না আমরা। তবে একটু সরে এসে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। খালে রাখা ভাসমান বাঁশের চার্ থেকে বিকট গন্ধ আসছে। পলিথিনের দিকে তাকিয়ে দেখি জোনাকিগুলো পলিথিনের সাথে লেপ্টে আছে। হিমু বেশ আগ্রহের সাথে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বখে যাওয়া কোনো বড়লোকের ছেলে মনে হচ্ছেনা, বরং একটা সরলতা আছে। নিশ্চয়ই এডভেঞ্চারের ঝোকে বাসা থেকে বেরিয়েছে।

... ... ...

গান্জাবাবার ওখানের বিস্তারিত বর্ণনা দিলাম না আর।
শুধু বলি, আধাঘন্টা পর গামছা প্যাচানো এক হাড্ডিসার ছেলে আসার পর নেশার আসর শুরু হয়।
কিন্তু হুট করে পুলিশের তাড়া খেয়ে আমরা ৪জন দৌড়ে পালিয়ে আসি...

এখন আপাতত ফুটপাতে গায়ের চাদরটা বিছিয়ে আমি আর হিমু শুয়ে আছি। জায়গাটা চেরাগি পাহাড়ের আশেপাশেই। ২০টাকা নগদে আজ রাতের জন্য এই জায়গাটা ভাড়া করেছি।

জোনাকিগুলো হাতেই রয়েছে এখনও। হিমু হয়তো এক্সট্রা ৫টাকা বাচানোর অভিপ্রায়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ভালোই...তাকিয়ে আছি আমরা আকাশের দিকে। আকাশের তাঁরার ভিতরে, "সপ্তর্ষিমন্ডল" টা আমার পছন্দের। ৭টা তারা গুচ্ছ হয়ে একটা "?" চিহ্ন তৈরি করে। যদিও আজ পর্যন্ত গুনে আমি ৬টা তারাই পেয়েছি। আজকেও ফের আরেকবার গোণা শুরু করলাম।

হঠাৎ মাইক্রোবাসের তীব্র আলোতে উঠে বসতে হলো একটু পর। শীতবস্ত্র বিতরণ ক্যাম্প! আমাকে আর হিমুকে দুটো চাদর দিয়ে চলে গেলো। ভালোই হলো, একটা চাদর পেতে শুবো, আরেকটা গায়ে। কিন্তু সমস্যা হলো, ওরা আমাদের চাদর হাতে ছবি তুলে নিয়েছে। ছবি তোলায় আমার এলার্জি আছে কিনা! স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট ব্যতিত আর কোথাও যে আমার ছবি নেই, এটা ভাবতেই বেশ লাগে। তবে আজ আরোও একটা উঠে গেলো!

যাহোক, ডাবল চাদর গায়ে দিয়ে হাটছি। হিমুর কাছে আমার পাওনা ২৫টাকা। ভাবছি এখন কি করবো? হিমু ওরফে মুহিত হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা জোছনায় অবশ হয়ে যায়। যদিও এটাকে চন্দ্রাহত বলছিনা। কারণ, হিমুর ছায়া পড়ছে..

রাত দ্বিপ্রহর। ল্যাম্পপোষ্টের তলায় দাড়িয়ে আছি। পাশে বস্তাবাবা, সামনে মাঠ। মুহিতকে বাসায় পৌছে দিতে হবে। একরাতের হিমুগিরির প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

- 'চলো খেয়ে আসি। ক্ষিদে পেয়েছে'
- 'কোথা থেকে?'
- 'শান্তি নিকেতনের জি:ব্লক থেকে।'
- 'ওখানে যাওয়া যাবেনা। আব্বু নিশ্চয়ই রেগেমেগে খুজতে বেরিয়েছে'
- 'ভালোই তো! উনি খুঁজে আসুক, ততক্ষণে খেয়ে নিই আমরা তোমার বাসায়। কি রেধেছে?'
- 'মুরগি ঝোল, খিচুড়ি আর বাকিগুলো জানিনা'
- 'বেশ! ওষুধটাও খাওয়ার সময় পেলেনা। মাইগ্রেনের ব্যথাটা যদি ফের বাড়ে?'

বলে হাত ধরে টান দিয়ে সোজা হাটা দিলাম শান্তির ব্লকে। হিমু যদিও অবাক হয়ে আছে। কিন্তু সবসময় মানুষের অবাক হওয়া মুখ দেখতে নেই। হাসি পায়!

... ... ...

টেবিলে বসে বাসি খিচুড়ি খাচ্ছি আর আশেপাশের উৎসুক জনতার ভিড় দেখছি। একেকজনের অভিব্যক্তি একেক রকম।

মুহিত মাথা নিচু করে প্লেটে হাত নাড়াচ্ছে!
মুহিতের বিপরীতে দাড়িয়ে ওর দাদী চোখ পাকাচ্ছে!
মুহিতের আম্মা হেসে হেসে ৩য় বারের মত খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে আমার প্লেটে!
বাড়ির কাজের ছেলেটা টেবিলের নিচ থেকে জোনাকিগুলো দেখছে...

কিন্তু শান্তিপর্ব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। আমার প্লেটে অর্ধেক খিচুড়ি থাকাবস্থায় মুহিতের বাবার আগমন। শর্ট টেম্পার্ড মানুষগুলো রেগে যায় জলদি, খুব হম্বিতম্বি করে, তারপর টুপ করে রাগ থামিয়ে বসে পড়ে। ইনিও তেমন!

মুহিতের সাথে আমাকেও বকলেন। আঙুল তুলে শাসালেন। একটু পর দেখি রাগ পড়ে গেলো। এখন চলবে কান্নাকাটি পর্ব! যা দেখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
জটলার মাঝে টুক করে আমি সটকে পড়লাম। কারণ, চাইনা ঝোলমাখা হাত দিয়ে তাদের সান্ত্বনাবাক্যে সায় জানাতে। আফসোস, খিচুড়িটা পুরো খেতে পারিনি।

রাস্তায় নেমে হাটছি মেসের উদ্দেশ্যে। হিমুর কাছে পাওনা আমার ৪০৳। থাক দেখা হলে চেয়ে নেয়া যাবে একদিন। পথে বস্তাবাবাকে একটা চাঁদর দিয়ে এসেছি। জোনাকিগুলো নিয়ে গিয়ে আমার রুমে ছেড়ে দিবো ভাবছি।

বহুদিন রাতে ঘুমাইনি। ঘুমানোর চক্রটা পেরেছি উলটে দিতে।
আচ্ছা, এই শীতের রাতে হাটাকেই কি মহাপুরুষগিরি বলে? অথবা যাবতীয় উদ্ভট আচরণগুলো?
জানিনা...
শুধু জানি আমি হাটি হাটার জন্য। আমি হাটি ঘুম আসেনা এজন্য।
তাছাড়া মধ্যরাতে এভাবে নগর ভ্রমণে বের হয়ে, 'খলিফা' ধাচের একটা অনুভূতি মিলে।

মাথার ব্যথাটা আবার বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এখুনি শুয়ে যেতে হবে। আজ আর মেসে ফেরা হচ্ছেনা তবে।

পাশে ল্যাম্পপোস্ট। আমার দেয়া চাদর গায়ে দিয়ে সেই বস্তাবাবা ঘুমিয়ে। সামনে মাঠ। জোনাকিগুলো ছেড়ে দিলাম।
ওদের মহাপুরুষ হওয়ার তাড়া নেই। আমারও আর ওদের দরকার নেই...

... ... ...

সিরিজঃ স্বচ্ছ
গল্পঃ ০৪
তারিখঃ ৪১০২/২১/৯২.

No comments

Powered by Blogger.