স্বচ্ছ সিরিজের - বছরের প্রথম বৃষ্টিবিলাস


বৃষ্টি পড়ছে।
বছরের প্রথম বৃষ্টি! আমি ভিজছি...
কোথায় যেনো শুনেছিলাম, বছরের প্রথম বৃষ্টিগুলোতে ভিজলে নাকি স্নিগ্ধতা বেড়ে যায়।
শরীরে পাপ জন্ম নেয়না আর! তবে এই সত্যতা পরখের উদ্দেশ্যে ভিজছি না। নেহাৎ ভিজতে ভালো লাগে বলেই ভেজা। আমার কাছে মোবাইল ফোনে ব্যালেন্স রাখা আর বৃষ্টির সময় ছাতা মেলে রাখা, দুটোই খুব বিরক্তের কাজ বলে গণ্য!

তিথীদের গেটের সামনে দাড়িয়ে আছি।
নতুন দাড়োয়ান রাখা হয়েছে গেটে। যার ফলস্বরুপ, গেট পেরিয়ে তিথীর নিকট আমার আগমনবার্তা পৌছানো আপাতত সম্ভব না।

খানিকটা ঘুরে তিথীর বারান্দা বরাবর গিয়ে দাড়ালাম। নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিথী গীফট্ পাঠিয়েছিলো, একটা হাতঘড়ি। সাথে বরাবরের মত সরল একটা চিঠি:

" Happy New Year!!!
বছরটা সুন্দর করে কাটানোর কামনা করি।
একটা ঘড়ি পাঠালাম, মন চাইলে হাতে দিও। অন্তত একবার হলেও দিনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, আমার কথা মনে পড়ুক।
অনেকদিন তোমাকে দেখিনা, সময় করে পারলে এসো।
নিজের খেয়াল একটু রাখো।

তিথী... "

চিঠি আর ঘড়ি দুটোই টেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রেখেছি।
অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পরেও যখন তিথীকে পেলাম না, হাটতে শুরু করলাম।

আমাদের দেশে কাক ও কবির সংখ্যা প্রায় সমান!
আজকাল এই সংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে সিটি কর্পোলেশন এর তৈরি গর্তের পরিমাণটাও বেড়ে চলেছে। আমি দাড়িয়ে আছি তেমনই এক গর্তের পাশে।
গর্ত খোড়া হচ্ছে ওয়াসার পানির লাইন বসানোর জন্য। চারপাশে উৎসুক জনতার ভীড়। এক ভদ্রলোক রিকশা থেকে নেমে একপলক উঁকি দিয়ে ফের রিকশা চেপে চলে গেলো! বোঝাই যাচ্ছে, গর্ত খোড়া এবং তা দেখার প্রতি এদেশের জনগণের আগ্রহ বেশ প্রবল।

সরকার বিভিন্ন সভা-সেমিনার করে মানুষকে কোন বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব বোঝানোর বৃথাই চেষ্টা করে! বরং তাদের উচিত, একটি বিরাটাকারের গর্ত খোড়ার আরম্ভ করা, যার আকর্ষণে জনতা ভীড় জমাবে। পাশে মঞ্চে উপবিষ্ট নেতারা গর্ত বরাবর তাকিয়ে তার স্পীচ্ দিয়ে যাবেন। জনতা গর্ত খোড়া দেখবে, পাশাপাশি বক্তৃতাও গিলবে!

যাহোক, কাজের কথায় আসি।
রাস্তার ওপর পাশে ছাতা হাতে এক ছেলে বেশখানিক যাবৎ একা দাড়িয়ে আছে। আর বারবার বিপরীত
দিকের তিনতলা বিল্ডিং এর দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় কারোও জন্য অপেক্ষা করছে।
আরোও কিছু সময় পর দেখি, বিল্ডিং এর দোতলার মাঝের সারির রুমের একটা জানালা খুলে গেলো। ছেলেটা সাথে সাথে রাস্তা পার হয়ে জানালা বরাবর দাড়ালো। জানালা থেকে এক কিশোরী মেয়ে মুখ বের করে ছেলেটার
উদ্দেশ্য কিছু একটা বললো। ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিয়ে, আরেকটা কিছু বললো। মেয়েটা রাগীভঙ্গিতে উত্তর দিয়ে জানালা লাগিয়ে দিলো। একটু হতাশ হয়ে চলে গেলো ছেলেটা মাথা নিচু করে।
... স্কুলজীবনের শহুরে প্রেম এটা।

আমি হাটতে শুরু করলাম। একটুপর দেখি ফুটপাতে এক মেয়ে কিছু ফুল বিক্রি করছে।
মনে মনে কদম খুজছিলাম, কিন্তু শীতকালেতো আর কদম পাবোনা! কিনে নিলাম ৫টা নাম না জানা ফুল।

বৃষ্টির জোর বেড়েছে। তিথীদের গেটে দাড়িয়ে আরেকবার শেষ চেষ্টা করলাম। দাড়োয়ানকে একটা ফুল দিয়ে ভেতরে পাঠালাম। তিথীর ছোট ভাইকে দিইয়ে বলতে বললাম, ওর স্কুলের এক বন্ধুর ভাই পাঠিয়েছে।
আগামীকাল ঐ ফুলটা ওর প্র্যাকটিকালে লাগবে তাই...

আমি জানি এতেই কাজ হবে। বেশ খানিক পরে দেখি তিথী গেট থেকে বের হয়ে এসেছে ছাতা হাতে। আমার হাত ধরে টেনে একটা রিক্সায় উঠালো। এখন রিক্সাভ্রমণ হবে হয়তো...

- 'ঘড়িটা পড়োনি হাতে'
- 'না'
- 'পছন্দ হয়নি?? যদিও তোমার কাছে পছন্দ নামক কোনকিছুর অস্তিত্বই নেই!'
- 'হেহেহে..'
- 'কতদিন পর দেখা হলো বলতে পারবা?'
- 'এইতো এক/দুই মাস মত হবে আরকি!'
- '৫৩ দিন!'
- 'বাদ দাও তো হিসাব নিকাশ...ফুল নাও'
- 'কি ফুল এটা?'
- 'এটা?...এটা..স্নিগ্ধকোমলি ফুল!'
- 'বানিয়ে বানিয়ে বলছো'
- 'হু'
- 'যাহোক, আপাতত এটা স্নিগ্ধকোমলিই হয়ে থাকুক'...

রিক্সার হুড্ খোলা ছিলো। আমার পরনে হালকা নীল একটা শার্ট ছিলো, বৃষ্টিতে ভিজে সেটা এখন গাঢ় নীল হয়ে গেছে।
.
.
রিক্সা জি.ই.সির মোড়ে থামলো। নেমে দাড়িয়ে থাকলাম। তিথী ভাড়া মিটিয়ে এলো। হাটতে লাগলাম..

"নিজের ড্রেসআপ যতই গোছগাছ হোক না কেনো, পাশ কাটিয়ে যদি অপর একজন টিপটপ ব্যক্তি যায়..আনমনেই নিজের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিবেই!"
- এরুপ ১টা টেন্ডেন্সি আজকাল অধিকাংশ শহুরে মানুষের মাঝে দেখা যায়।

আমাদের সামনে আরেক তরুণী তার ছেলে বন্ধুর সাথে হাটছিলো। দুজনই যথেষ্ট স্মার্ট লুকিং। কিন্তু ঐ যে "চোখ বুলানো টেন্ডেন্সী".. তরুণী বারবার পিছে তাকিয়ে দেখছে। আমি খুব সুদর্শন তাই দেখছেনা, বরং আমার মত ভ্যাগাবন্ডের পাশে এমন মেয়ে কি করছে তাই সে বোঝার চেষ্টা করছে!

বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একটা স্টেশনারীর দোকানে ঢুকলো তিথী। একটা ডায়রী, কলম টুকটাক জিনিস কিনে বেরিয়ে এলো। তারপর ফুচকার দোকানে গিয়ে ফুচকা খেলো একা একা। আমি খাবোনা সেটা ভালো করেই জানে।
পাশে বসে ছিলাম শুধু...

দুপুর ২টা মত বাজে হয়তো। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। তবু তিথী ছাতাটা ধরে হাটছে।

- 'আচ্ছা স্বচ্ছ..'
- 'হু'
- 'কবিতা পারো?'
- 'ছোটবেলায় শিখেছিলাম.. "সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি"..'
- 'না..অন্যরকম কোন কবিতা?'

আমি ভাবতে লাগলাম..

- 'আমি খুঁজে দেখিনি সিক্ত ও চোখে প্রেম নাকি অভিমান.
আমি চেয়ে বসিনি তোমার ঠোটেতে সুরেলা কোন গান.
আমি হেটে গিয়েছি বিকাল পথে
তুমি নেই বারান্দায়.
তবু রাতটা শেষে বুঝেছি নিজেকে স্বপ্নীল এক পেয়ালায়...
জানি তুমি জেগে নেই...আমার চোখে ঘুম নেই..'

- (নীরবতা)
- 'চলবে?'
- 'আর দশটা প্রেমিকার থেকে আমি আলাদা, কারণ তুমি আর দশজনের মত নও। দিনের পর দিন চলে যায় আমাদের দেখাই হয়না! তবু আমি তোমাকে ভালোবাসি..জানি শুধু এটুকুই তুমি একটা পাগল!'
- 'আমার কবিতার প্রশংসা কোথায়? তোমার উচিত ছিলো ভালো বলার!'
- 'খুব ভালো হয়েছে'
- 'হেহেহে...আমার কাছে টাকা নাই। কিছু টাকা দাও, গ্যাস বেলুন কিনবো'

তিথী টাকা বের করে চুপ করে তাকিয়ে থাকলো।

শতায়ু অঙ্গনে সিড়ির উপর বসে আছে তিথী।
সামনে পুরো শহরের একটা অংশ দৃশ্যমান। পাহাড়ের উপর হওয়ায় বাতাসও আছে বেশ। হাতে অনেকগুলো বেলুনের সুতো আমার। একটা একটা করে উড়াচ্ছি। মাঝারি আকারের বেলুনগুলো উপরে উঠে যাচ্ছে। পাশে একটা টোকাই দাড়িয়ে অদ্ভুত আবেশে তাকিয়ে দেখচে বেলুনগুলো।

সব বেলুনগুলো উড়ে যাবে। হয়তো গিয়ে পৌছাবে শহরের অন্য কোন প্রান্তে।
হয়তো কতগুলো টোকাই হাতের বস্তাটা ফেলে দিয়ে পাল্লা দিয়ে দৌড়াবে বেলুন ধরতে।
কিছু উড়ে যাবে একলা ছাদে বসা কোন তরুণীর গা ঘেষে, যে আজ সকালে বৃষ্টিতে ভিজে দাড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে বকা দিয়েছে। কিছু হয়তো কোথাও পড়বেনা, হারিয়ে যাবে। কেউ হয়তো ভাববে,
"ঢং!! দেশের লোকে ভাত পায়না, আর হেতেরা উদ্বোধনীর নামে বেলুন উড়ায়..যত্তোসব!!"
কেউ হয়তো ছোট বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বলবে,
"বাবু দেখো, কত্তগুলা বেলুন! জলদি ভাতটা খেয়ে নাও, আমরাও বেলুন উড়াবো!"
কেউ হয়তো কিছুই বলবেনা...

তবে কেউ জানবেনা যে, বেলুনগুলো ওড়ানো হয়েছে ধার করা টাকায়। একজন সুখি মানুষ এগুলো উড়িয়েছে, যার কিনা সকল স্বপ্নগুলোই ওমন রঙিন গ্যাস বেলুনে ওড়ানো! কেউ জানলোনা আজ স্বচ্ছ কতটা স্নিগ্ধ!

বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। নতুন বছরের স্নিগ্ধ বৃষ্টি। আবার ভিজতে যাবো।
পাশাপাশি দুজন স্নিগ্ধ মানব-মানবী হিসেবে।
তিথীর স্বচ্ছ হিসেবে।

... ... ...

সিরিজঃ স্বচ্ছ
গল্পঃ ০৫
তারিখঃ ৫১০২/১০/০২.

No comments

Powered by Blogger.