স্বচ্ছ সিরিজের - কয়েকটি দ্বিপ্রহরের রাতে
রাত দ্বিপ্রহর।
সাধারণত এই সময়টাতে শহরের উন্মুক্ত রাস্তায় কুকুর,বাদুর আর মলমপার্টির বেশ আনাগোনা থাকে।
তেমনই এক রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে দাড়িয়ে আছি দশমিনিট যাবৎ। টিমটিম করে টিউবলাইট টা জ্বলছে নিভছে। আর আলোর পোকাগুলো সেখানে ঘিরে করছে আলোকনৃত্য। এই শহরের সুখি মানুষগুলো সবাই ঘুমাচ্ছে, কাল ভোরের অপেক্ষায়।
আর আমি? চাদর মুড়ি দিয়ে দাড়িয়ে আছি, পুলিশের নিকট এই সজ্জা মোটেও সুখকর নয় জেনেও। ইদানিং এটা অভ্যাসে দাড়িয়ে গেছে। মেসে একলা থাকায় বাধা দেওয়ারও কেউ থাকেনা।
ফুটপাতে এই শীতের সময় বস্তাবাবাদের আনাগোনা দেখা যায় বেশি।
সারাবছর যারা শহরের বিভিন্ন পাইপ, সিড়িঘর দখল করে রাখে তারাই এই শীতের রাতে ফুটপাতে বেরিয়ে আসে।
এরকম বস্তাবাবার সাথে আগেরদিন কথা হয়েছিলো। কথায় কথায় জানতে পেরেছি, তার স্থায়ী ঘুমানোর জায়গা রেলস্টেশন। তবে শীতের সময়টা সে ও তার পরিবার আলাদা আলাদা হয়ে ফুটপাতে বস্তা মুড়ি দিয়ে ঘুমায়। যাতে শীতবস্ত্রবিতরণকারী সংস্থার নিকট থেকে আলাদা আলাদা চাদর/কাপড় আদায় করতে পারে।
পরবর্তিতে সেই চাদর/কাপড় হকারে সেকেন্ড হ্যান্ডে বিক্রি করে দেয়।
এর মাঝে আবার কথা আছে, যে বস্তা তারা গায়ে দিয়ে থাকে, সেটাও কিন্তু ভাড়ায় নিতে হয়।
প্রতিরাত ৫টাকা করেতো থাকেই, সাথে আদায়কৃত চাদর/কাপড় বিক্রির টাকার এক অংশও দিতে হয়। তাদের এই অভিনব পন্থা নিঃসন্দেহে হীতকরই বটে।
সেরকমই এক বস্তাবাবার পাশে আমি দাড়িয়ে আছি।
এদের ঘুমানোর পদ্ধতিটাও অনেকটা শিল্পের কাছাকাছি। একজনকে দেখলাম, দেহের তুলনায় বস্তা খাটো। সে মাথা ঢাকা দিয়ে পা খোলা রাখছে। কিছুক্ষণ মশার কামড় সহ্য করার পর গায়ের কাপড়টা খুলে পায়ে জড়ালো।
তাতেও হলোনা দেখে, আস্তে করে বস্তার ভিতর ঢুকে গিয়ে গোটমোট হয়ে শুয়ে গেলো।
আমার মাথায় এটা এখনও ঢুকলোনা এইটুকু একটা বস্তার ভিতরে টুক কি করে পুরোটা ঢুকা সম্ভব!
কায়দাটা পরে শিখে নিতে হবে।
যাহোক, হাটা শুরু করলাম।
লালখান বাজারের মোড়টা ঘুরে বায়ে স্টেডিয়ামের দিকে উদ্দেশ্যহীন গন্তব্য।
লেডিস কর্ণারের সামনে যেতে দেখি একদল কুকুর এক পাগলকে ঘিরে জটলা পাকিয়ে আছে।
পাগল বললাম এই কারণে, কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এত রাতে একদল কুকুরকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে লেকচার দিবেনা।
তাকে বলতে শুনলাম,
- 'এক দুই তিন চার ফক্কা! এই চিরিং...তুই ঐদিক কি দেখছিস? দেখ, এক দুই তিন চার ফক্কা!'
বলেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাতটা ভাজ করে দু পায়ের ফাকে ঘুরিয়ে আনছে। আর অনবরত বলেই চলেছে,
- 'এক দুই তিন চার ফক্কা...এক দুই তিন চার ফক্কা...'
কুকুরগুলোও শান্ত হয়ে আছে।
যাকে চিরিং বলে ডাকা হয়েছিলো, দেখলাম তার লেজের অর্ধেকটা নেই। ফক্কা বলার সাথে সাথে সেও কুইকুই করে কাটা লেজ নাড়ছে। আমার অস্তিত্ব তারা এখনও খেয়াল করেনি অবশ্য।
তবে খানিকটা কাছে এগিয়ে যেতেই কুকুরের দলপতি গরগর করে উঠলো। আমার উদ্ভট বেশভুষাই হয়তো তার কারণ। ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলেও কুকুরগুলো কিছু করে উঠার আগেই পাগলটা হাত নাড়িয়ে থামালো। আমিও দাড়িয়ে গেলাম। পাগলের সামনে গিয়ে হাতটা বাড়ালাম, বেশ স্বাভাবিকভাবেই হ্যান্ডশেইক করলো। বললাম,
- 'কেমন আছেন?'
- 'জ্বী ভাই ভালো। আপনার শরীরটা ভালো তো?'
- 'জ্বী ভালো। ভাই আপনি এখানে কি করতেছিলেন?'
- 'নাই বা জানলেন। আপনার কথা বলেন, শহর নিয়ে পেরেশানে আছেন মনে হয়?'
- 'নাতো ভাই, আমার কোন পেরেশান নাই।'
এটা শুনে হোহোহো করে হেসে উঠলো। সাথে কুকুরগুলোর গরগরের পরিমান বেড়ে গেলো।
একটু হকচকিয়ে গেলাম। কেমন যেনো গা গোলানো হাসিটা।
মস্তিষ্কের ভিতরে কেউ যেনো তারস্বরে চেচাচ্ছে, 'যাও চলে যাও জলদি...বিপদ...বিপদ!'
আমি বিদায়ের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললাম,
- 'আবার দেখা হবে!'
বলেই হাটা শুরু করলাম। পিছনে ফিরেও দেখিনি আর। তবে পিছন থেকে বলতে শুনলাম,
- 'নড়বে সব নড়ে যাবে...খালি এক দুই তিন ফক্কার খেলা! এক দুই তিন ফক্কা...এক দুই তিন...হা হা হা...'
আজ রাতের মত হাটাহাটি বন্ধ করে মেসে ফিরে এলাম। কেমন যেনো অদ্ভুদ গা শিরশিরে অনুভূতি।
এদিকে মাথার ভিতর রিদমিক এলার্মের মত বেজেই চলেছে, 'এক দুই তিন চার ফক্কা!'
ড্রয়ার থেকে দুটো হিপনল নিয়ে পানি দিয়ে গিলে খেলাম। অসহ্য মাথা ব্যথাটা হওয়ার আগেই ঘুমোতে চাইছি।
... ... ...
পরদিন বেলা এগারোটায় ঘুম ভাঙলো।
ওয়াশরুমে গিয়ে প্রাতঃকর্ম সেরে নিচে নামলাম। শান্তির হোটেলে গিয়ে ডালপুরি আর চা খেয়ে বের হলাম। উদ্দেশ্য ডিসি হীল্। পথে যেতে যেতে লালখান বাজারের ঐ রাস্তার দিকে একনজর তাকালাম। মাথার ভিতর ক্ষীণ তবে স্পষ্ট স্বরে বেজে উঠলো, 'এক দুই তিন চার ফক্কা!'
পাত্তা দিলাম না।
নজরুল স্কয়ারে গিয়ে দেখি ফাকা ফাকা ভাব। কেবল বসার বেঞ্চগুলো দখল করে আছে স্কুল/কলেজ পালানো ছেলের দল, নার্সারীর ভিতরের রাস্তায় আড়ালে বসে আছে কপোত-কপোতির দল।
আর আপাতত আমি বসবো ভাবছি, নজরুলের সামনে।
হাতে ঘড়ি নেই, তাই সময়টা বলতে পারছিনা। তবে তিথীর আসার সময় যে হয়ে গেছে এটা স্পষ্ট। বিগত এক সপ্তাহ সমানে চাপ দিয়ে যাচ্ছে দেখা করার জন্য। আজ অনেকটা বাধ্য হলাম।
ঐ তো তিথী আসছে। নিশ্চিত আজ ক্লাস ফাকি দিয়েছে। কাছে এসেই কোনরকম আড়ষ্টতা বাদ দিয়েই পাশে এসে বসে পড়ল। আমি আমার বিখ্যাত অমায়িক মার্কা হাসিটা দিলাম। কিন্তু না, আজকালকার মেয়েরা এ হাসিতে আর দ্রবীভূত হয়না। তিথীতো নয়ই! যাহোক, কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিথী বললো,
- 'বাহ, আজকাল হিমুর মত ভং ধরেছো দেখছি!'
- 'কই নাতো!'
- 'তাহলে রাতবিরাতে হাটাহাটি করো কেনো শুনি??'
- 'আমি আসলে পথমানুষদের নিয়ে একটা জরিপ চালাচ্ছি। দেখতে চাইছি যে, কত.....'
- 'থাক থাক, তোমার উদ্ভট কাজের ব্যাখ্যা আমাকে দিতে হবেনা।'
- 'ডেকেছো কেনো?'
- 'দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই!'
- 'দেখাতো শেষ। এবার তাহলে যাই?'
- 'খুব ব্যস্ত দেখছি!'
- 'হ্যা, অনেক কাজ আছে। শহরের মানুষকে সাবধান করতে হবে। খুব জলদি একটা ভূমিকম্প হবে।'
- 'Enough! আর বলতে হবেনা! যাও...'
অমায়িক একটা হাসি দিয়ে আমি সত্যি সত্যি উঠে হাটা শুরু করলাম। পিছে তাকালাম না।
তবু বলতে পারি, মেয়েটা অভিমানী দৃষ্টিতে আমার চলে যাওয়া দেখছে।
আমি চুপচাপ হেটে চলে এলাম।
... ... ...
রাত দ্বিপ্রহর।
আমি লেডিস কর্ণারের সামনে দাড়িয়ে আছি।
আজ পাগলটা কোন কথা বলছেনা কেনো? কুকুরগুলোও চুপচাপ। আমাকে দেখে পাগলটা একবার মুখ তুলে তাকালো তারপর আবার আগের মত চুপ।
ব্যপারটা বুঝলাম না। কাছে এগিয়ে দেখি, ৫টা পাথর একটা চক্রাকারে সাজিয়ে তার দিকে পাগলটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কি জানি বিড়বিড় করে যাচ্ছে। যদিও বেশ আন্দাজ করতে পারছি, সে কি বলছে!
আমিও একপাশে চুপচাপ বসে তার কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম।
প্রায় মিনিট তিরিশ পর, পাগলটা আমাকে কাছে ডাকলো। কাছে গেলে হাতের ইশারায় একটা পাথর তুলতে বললো।
তুললাম। তারপর পাথরটা হাতে নিয়ে চলে যেতে বললো। আমিও হাতে নিয়ে সোজা উঠে চলে এলাম।
কেনো যেনো মনে হলো, আমি আধ্যাত্মিক কোন জগতে আছি। এবং সেখানকার একটা অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। রোবটের মত আমি বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। খেয়াল করলাম, চিরিং ও আমার পিছে পিছে আসছে।
আমি এসে দেওয়ানহাট ব্রীজের উপর দাড়ালাম।
হাইওয়েতে শা শা করে গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে। চিরিং এর দিকে তাকালাম। দেখি, পাশে দাড়িয়ে লেজ নাড়ছে।
পাথরটা নিয়ে কিছুক্ষণ হাতবদল করলাম, এরপর সামনের অন্ধকারে ছুড়ে মারলাম জোড়ে।
এবং তৎক্ষণাৎ ব্রীজটা দ্বিগুণ জোরে দুলে উঠলো। একবার...তারপর আবার...
অনেকগুলো কাক ডাকতে ডাকতে উড়তে লাগলো। আশেপাশের বিল্ডিং এর রুমগুলোয় আলো জ্বলতে লাগলো..হুড়োহুড়ি...চেচামেচিও শুরু হয়ে গেলো।
বুঝলাম, একটা ভালো রকমের ভূমিকম্প হয়েছে।
কেনো যেনো অবাক হলাম না। মনে পরলো 'নড়বে সব নড়ে যাবে...', পাগলটা বলেছিলো।
তবে পাগলটা কি করে জানলো যে, একটা ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে?শুনেছি পিপড়া জাতীয় প্রাণিরা বৃষ্টি হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই বুঝতে পারে। তখন তারা গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।
তবে পাগলটার কি তেমন কোন শক্তি আছে? নাকি সবই আমার কল্পনা!
আর ভাবতে পারছিনা! মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে!
মাথার গভীর থেকে কেবল শুনছি, 'এক দুই তিন চার ফক্কা!...এক দুই তিন চার ফক্কা....'
তারপর আর মনে নেই।
... ... ...
নিজেকে আমার মেসের বিছানায় পেলাম। কিছু উৎসুক চেহারা আমার দিকে ঝুকে রয়েছে।
শুনলাম, আমাকে রুমমেটের ছোটভাই নাকি লেডিস কর্ণারের সামনে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকতে দেখেছে। খবর পেয়ে রুমমেট আমাকে নিয়ে এসেছে। এবারও কেনো যেনো শুনে অবাক হলাম না!
খালি মাথাটা আবার চক্কর দিয়ে উঠলো।
... ... ...
(এক সপ্তাহ পর)
শীতবিতরণ একটা ক্যাম্পিং এ চাদর বিলি করছি ফুটপাথে থাকা মানুষগুলোকে। পরিচিত বস্তাবাবারাও ছিলো।
আমাকে দেখে একটু শঙ্কিত হলেও, মুখে প্রকাশ করলোনা কেউ! সঙ্গে তিথীও ছিলো।
চাদর দিতে দিতে একপর্যায়ে সেই পাগলটাকেও লাইনে পেলাম। আমাকে দেখে একটু হেসে বললো,
- 'ভাই শরীরটা ভালোতো?'
আশেপাশে তাকিয়ে চিরিং কে খুজলাম, পেলাম না। পুনরায় তাকিয়ে জবাব দিতে গিয়ে দেখি কেউ নেই।
তিথীকে জিজ্ঞাস করলাম, 'এই মাত্র যে পাগলটা দাড়িয়ে ছিলো সে কই?'
বেশ অবাক হয়ে তিথী বললো, 'এখানে পাগল পেলে কোথায়?'
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
ক্যাম্পিং শেষে ফেরার পুরো পথটুকু চুপ করে ছিলাম।
কেবল চুপ থাকেনি আমার মস্তিষ্কটা। অনবরত বকে চলেছে,
"এক দুই তিন চার ফক্কা!...এক দুই তিন চার ফক্কা!..."... ... ...
তারিখঃ ৪১০২/১১/২১.
⟸⧫⟹
[মূলত এটিই ছিলো "স্বচ্ছ সিরিজ" এর প্রথম গল্প।
নেহাত শখের বসেই পরপর কয়েকটা লিখে ফেলা, যা পরবর্তিতে একটা আস্ত সিরিজে রূপ নেয়।]


No comments